“মা মুখ দিয়ে খাবে আর শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে"
– এই স্লোগানটি সামনে রেখে আজ আমি এই আর্টিকেলটি লেখা শুরু করছি। মা হচ্ছে শিশুর জীবনে
বটবৃক্ষের মতো। তিনি শিশুকে প্রয়োজনীয় সব কিছু সরবরাহ করেন। শিশু জন্ম গ্রহণ পর মায়ের
দায়িত্ব শুরু হয় না বরং পেটে থাকা কালীন তার দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। শিশু পৃথিবীতে
আসার পর যাতে তার কোন পুষ্টির ঘাটতি না হয় এজন্য কোন মহিলা গর্ভবতী হলেই শিশুর দৈহিক
গঠন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির কথা ভেবে তাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছু খেতে হয়। তাই
আজকের এই আর্টিকেলে আমি গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা আপনার সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি।
আপনি যদি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়েন তবে গর্ভবতী মায়ের খাবার
সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত ধারণা পাবেন। যদি আপনি কোন গর্ভবতী মা হয়ে থাকেন তাহলে এই
খাবারগুলো আপনাকে অবশ্যই খেতে হবে। যদি আপনি গর্ভবতী স্ত্রীর স্বামী হয়ে থাকেন তবে
তার সঠিক পুষ্টির জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে অবশ্যই এই খাবারগুলো খাওয়াবেন। নাহলে জন্মের
পর আপনার শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে বিভিন্ন সমস্যা সম্মুখীন হতে পারে। চলুন, এবার
দেখে নেওয়া যাক গর্ভবতী মায়ের জন্য সেরা খাবার তালিকা – অর্থাৎ গর্ভবতী মায়ের কি কি
খাবার খাওয়া উচিত।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
★ ভিটামিন
ভিটামিন হল এক ধরনের জৈব পরিপোষক
সাধারণ খাদ্য। এটি গর্ভবতী মায়ের জন্য খুব প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। বিশেষভাবে
গর্ভবতী মায়ের ভিটামিন এ ও ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার বিকল্প নেই। সাধারণত ভিটামিন
শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এজন্য গর্ভবতী মায়ের সব ধরনের
ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে ভিটামিন এ ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার
বেশি বেশি খেতে হবে।
ভিটামিন ডি এর অভাবে শিশুদের রিকেটস রোগ হয়, হাড় ঠিক মত বাড়তে পারে না এবং হাড় বাঁকা হয়ে যায়। এছাড়া ভিটামিন ডি দেহের অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণ করে। তাই শিশুর রিকেটস রোগ সহ যাবতীয় অস্থির সমস্যা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার যেমন: সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল, উদ্ভিজ্জ তেল, গরুর কলিজা, ডিম, দুধ, দই, পনির ও মাশরুম পর্যাপ্ত পরিমানে খেতে হবে।
★ আয়োডিন
বাড়ন্ত শিশু ও গর্ভবতী মায়ের জন্য আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আয়োডিন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সাধন করে এবং শারীরবৃত্তীয় কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করেন। এছাড়া আয়োডিনের অভাবে শিশু প্রতিবন্ধী হয়। তাই শিশু যাতে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম গ্রহণ না করে তার জন্য গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত আয়োডিনযুক্ত লবণ সহ চিংড়ি মাছ, টোনা মাছ, কলা, কলার মোচা, দুধ, টক দই, ডিম, স্ট্রবেরি ও ভুট্টা যথেষ্ট পরিমাণে খেতে হবে।
★ ক্যালসিয়াম
শিশুর হাড়ের গঠনে ক্যালসিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্যালসিয়াম শিশুর হাড়কে শক্ত করে এবং হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুর হাড় দুর্বল হয়। এছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবে গর্ভবতী মায়ের হাড়ের ক্ষয় হয় এবং কোমর ও পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা হতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে এবং নিজের স্বার্থে গর্ভবতী মায়ের প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, টক দই, পনির, তিল, সোয়াবিন, কাঠবাদাম, খেজুর, কমলা, পালংশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি শালগম, বেগুন, ঢেড়স ইত্যাদি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
★ আয়রন
আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। আর হিমোগ্লোবিন শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করে। আয়রনের অভাবে শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যায়। ফলে রক্তশূন্যতাসহ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অনেক শিশু জন্মের পরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এর মূল কারণ হলো গর্ভবতী মায়ের আয়রনের অভাব। তাই গর্ভবতী মাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন: কলিজা, সামুদ্রিক মাছ, সোয়াবিন, বাদাম, আপেল, খেজুর, ডালিম, ছোলা, ডাল, কুমড়ো বীজ, কচু শাক, লাল শাক পালং শাক, কাঁচকলা, বিটকপি ইত্যাদি খেতে হবে। তা না হলে শিশুর জন্মের পরেই আয়রনের অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
★ ফলিক এসিড
ফলিক এসিড হল ভিটামিন বি নাইন এর রূপ যা ফোলেট নামেও পরিচিত। ফলি ফলিক এসিড মানবদেহে ডিএনএ গঠন করে, কোষ বিভাজন করে এবং ডিএনএ মেরামতে সাহায্য করে। লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করতে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে ফলিক এসিড এর জুড়ি নেই। বিশেষভাবে ফলিক এসিড গর্ভবতী মায়ের গর্ভের শিশুর হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্ক সুস্থ রাখে এবং অঙ্গহানি প্রতিরোধ করে। তাই গর্ভবতী মায়ের ও নবজাতকের জন্য ফলিক অ্যাসিড অত্যাবশ্যক। ফলে গর্ভবতী মায়ের ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য শস্য, যেমন: তিল, তিসি, সূর্যমুখী বীজ, লাল আটা ও লাল চাউল, শাক সবজি যেমন: সরিষা শাক, পাটশাক, মূলাশাক, পুইশাক, মটরশুঁটি, বাধাকপি, ব্রকোলি, শিম, বরবটি ও সব ধরণের ডাল, ফলমূল যেমন: পেপে, লেবু, আম, জাম, জামরুল, আতা, আঙ্গুর, কমলা ও লিচু নিয়মিত খেতে হবে।
★ জিংক
গর্ভবতী মায়ের জন্য জিংক এর গুরুত্ব অপরিসীম। গর্ভবতী মায়ের
শরীরে জিংক এর পরিমাণ কমে গলে কম ওজনের শিশু জন্ম নিতে পারে। এছাড়া জিংকের অভাবে পরবর্তীকালে
শিশুর নিউমোনিয়া, বিভিন্ন প্রকার ঘা ও মানসিক বিকাশের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই শিশুর
এসব সমস্যার কথা মনে রেখে গর্ভবতী মায়ের জিংক সমৃদ্ধ খাবার যেমন: সামদ্রিক মাছ, গরুর
মাংস, ভেড়ার মাংস, গরু ও খাসির কলিজা, দুধ, দই, পনির, চীনাবাদাম, মাসরুম শীম জাতীয়
উদ্ভিদ ও সোয়াবিন প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
পড়তে পারেনঃ
২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
★ আয়রন
২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় আয়রন অত্যাবশ্যক।
এই সময় গর্ভবতী মায়েদের শক্তিশালী রক্ত প্রবাহের প্রয়োজন হয়। আর আয়রন শক্তিশালী
রক্ত প্রবাহের জন্য ব্যাপক সাহায্য করে। তাই ২ মাসের গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায়
আয়রন জাতীয় খাবার যেমনঃ মুরগি, ডিম, পালংশাক, বিটরুট, মেথি ইত্যাদি যোগ করতে হবে।
★ ক্যালসিয়াম
২ মাসের গর্ভবতী মায়ের অস্টিওপোরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক
বেশি। ক্যালসিয়াম অস্টিওপোরোসিস এর সম্ভাবনা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। তাই এই সময় গর্ভবতী
মায়ের খাবার তালিকায় ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার যেমনঃ বাধাঁকপি, শালগম ও শাকসবজি যোগ
করতে হবে।
★ ফাইবার
২ মাসের গর্ভবতী মায়েরা হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। তাই এসময় গর্ভবতী মায়ের প্রচুর পরিমাণে ফাইবার জাতীয় খাবার যেমনঃ মটরশুটি, শিম, ডাল, কমলা, অ্যাপেল ও গাজর খাওয়াতে হবে। এই খাবারগুলো ২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাওয়ালে হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যাবে। এছাড়া ২ মাসের গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় আরো থাকবে ফলিক এসিড, প্রোটিন, চর্বি ইত্যাদি।
৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভবতী মায়ের তৃতীয় মাস একটি ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট। এ সময়
গর্ভবতী মা বার বার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে সকালে অসুস্থতা খুব বেশি দেখা যায়। এছাড়া
এসময় গর্ভবতী মায়ের মেজাজের বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আসলে এ সময় গর্ভবতী মায়ের
শিশুর ভ্রুণের বৃদ্ধি ঘটে। তাই তাকে যেকোনোভাবে মানসিক চাপমুক্ত রাখতে হবে। আর ৩ মাসের
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় যা যা রাখতে হবে তা একবার জেনে নিন।
★ টাটকা ফল
টাটকা ফলে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে
যা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। তাই এসময় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায়
টাটকা ফল যেমন: আপেল, পেয়ারা, কমলা, স্ট্রবেরী, কলা, বেদানা, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি রাখতে
হবে।
★ শাকসবজি
৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় শাকসবজি রাখা বাধ্যতামুলক
কারণ শাকসবজি হল পুষ্টির হাউস। আর এসময় গর্ভবতী মায়ের প্রচুর পুষ্টির দরকার হয়। তাই
এসময় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় বাঁধাকপি, ব্রোকলি, পালংক শাক, গাজর, বেগুন, কুমড়া
ইত্যাদি রাখতে হবে।
★ ভিটামিন বি-৬
তৃতীয় মাসে গর্ভবতী মায়ের বমিবমি ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়।
আর এই বমিবমি ভাব দূর করতে পারে একমাত্র ভিটামিন বি-৬। তাই ৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার
তালিকায় ভিটামিন বি-৬ সমৃদ্ধ খাবার যেমন: চর্বিহীন হাস ও মুরগীর মাংস, বাদাম, অ্যাভোকাডো
ও বিভিন্ন ধরণের বীজ রাখতে হবে।
★ ফোলেট
তৃতীয় মাসে গর্ভবতী মানুষের শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ডের বিকাশ
লাভ করতে শুরু করে। আর ফোলেট এই মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ডের বিকাশের জন্য প্রচণ্ড হেল্প
করে। তাই এসময় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন: কলা, পেপে, চিনাবাদাম,
কমলা, টমেটো, মটরশুটি, লেটুস, ব্রোকলি, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি রাখতে হবে।
★ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
তৃতীয় মাসে গর্ভবতী মায়ের শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ওমেগা-৩
ফ্যাটি এসিডের খুব প্রয়োজন হয়। তাই এসময় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি
এসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন: সামদ্রিক মাছ, সয়াবিন, আখরোট, চিয়া বীজ ইত্যাদি যোগ করতে
হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে যদি কোন গর্ভবতী মা আমার উল্লেখিত গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা ফলো করেন তাহলে তার নবজাতক প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে রোগমুক্তভাবে পৃথিবীতে আসবে। আপনার আদরের কাঙ্খিত সন্তান পৃথিবীতে আসার পর তাকে নিয়ে আর ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হবে না। সুতরাং, সময় থাকতে গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা ফলো করুন এবং আপনার সন্তানের ভবিষ্যত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করুন।
রিলেটেড পোস্টসঃ