বর্তমান সময়ে একটি জনপ্রিয়
ভেষজের নাম চিয়া সিড। এটি
স্বাস্থ্যের জন্য প্রচন্ড উপকারী। চিয়া সিড দেখতে আকারে খুব ছোট হলেও এর পুষ্টিগুণের
জুড়ি নেই। এতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ফাইবার ও প্রোটিন আছে।
এছাড়া এতে আছে ভিটামিনের সমান থায়ামিন বি১, রিবোফ্লাভিন বি২, নিয়াসিন বি৩, ফোলেট
বি৯, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাসিয়াম, জিংক
ও আরো অনেক পুষ্টি উপাদান। এতসব পুষ্টি উপাদানের কারণে চিয়া সিডকে সুপার ফুডও বলা হয়। ডায়াবেটিস
রোগীদের জন্য এটি নাকি একটি অন্যতম সুপার ফুড। এটি
কি সত্যিই উপকারী নাকি এর কোনো অপকারিতাও আছে? আজ আমি এই আর্টিকেলে চিয়া সিড এর উপকারিতা, অপকারিতা ও সঠিক খাওয়ার নিয়ম সহ
চিয়া সিড সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আপনি চিয়া সিড সম্পর্কে আসল সত্য জানতে আর্টিকেলেটি
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারেন।
চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা
চিয়া সিড সালভিয়া হিস্পানিকা
বা চিয়া উদ্ভিদের অন্তর্ভুক্ত এবং পুদিনা পরিবারের একটি প্রজাতি। সর্বপ্রথম মধ্য
ও দক্ষিণ মেক্সিকো ও দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকায় এই চিয়া সিড চাষ শুরু হয়। পরবর্তীকালে
একাবিংশ শতাব্দীতে চিয়া সিড মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার পাশাপাশি বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া
ও অস্ট্রেলিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। চিয়া সিড দেখতে ছোট, চ্যাপ্টা
ও ডিম্বাকৃতির এবং এর রং বাদামি, ধূসর, কালো ও সাদা। মূলত চিয়া সিড হাইড্রোফিলিক
এবং ভিজলে তার ওজনের ১২ গুণ তরল শোষণ করে এবং জেলির মত হয়।
চিয়া সিডের উপকারিতা
চিয়া সিডের পুষ্টিগুণের
কথা লিখে শেষ করা যাবে না। চিয়া সিডে স্যামন মাছের চেয়ে ৮ গুণ বেশী ওমেগা-৩ ফ্যাটি
এসিড, কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম, দুধের
চেয়ে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম এবং পালংশাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশি আয়রন থাকে। একারণেই চিয়া
সিডকে সুপার ফুড বলা হয়। এখন আপনার জানার জন্য চিয়া সিডের অবাক করা উপকারিতা এই আর্টিকেলে
তুলে ধরা হল। চলুন তাহলে চিয়া সিডের উপকারিতা জেনে নেওয়া যাক।
ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ করে
বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘরে
ঘরে ডায়াবেটিস রোগী। এই ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের খাদ্য নিয়ে খুব সমস্যায় থাকে। কোন
খাদ্য একটু বেশি পরিমাণে খেলেই তাদের ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। তারা সব সময় চিন্তা
করে এমন কি খাদ্য বা ঔষধ আছে যা খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকে। তারা জানে না
যে তাদের হাতের কাছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মহৌষধ চিয়া সিড। চিয়া সিড প্রচন্ডভাবে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। চিয়া সিডে এমন অনেক পুষ্টি উপাদান আছে যা ডায়াবেটিস রোগীদের
রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়, শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ইনসুলিন
তৈরিতে সহায়তা করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত।
হাড় শক্তিশালী করে
হাড়কে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন
প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস যা চিয়া সিডে পর্যাপ্ত পরিমাণে
আছে। তাই যাদের হাড়ের সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত। নিয়মিত চিয়া সিড
খেলে হাড়তো শক্তিশালী হয় সাথে সাথে হাড়ের যাবতীয় সমস্যা সমাধান হয়। তাই হাড়কে
শক্তিশালী করতে একটানা ৬ মাস চিয়া সিড খেয়ে হাতেনাতে ফল নিতে পারেন।
শরীরে শক্তি সরবরাহ করে
কোন ইঞ্জিন চালানোর জন্য
যেমন শক্তি প্রয়োজন ঠিক তেমনি হিউম্যান ইঞ্জিন বা মানব শরীর চালানোর জন্য শক্তি প্রয়োজন।
মানব শরীরে শক্তি না থাকলে সারাদিন কাজকর্ম করা যায় না। চিয়া সিড মানব শরীরে শক্তি
যোগাতে পাওয়ার হাউস হিসাবে কাজ করে। তাই দৈনন্দিন কাজকর্ম সুন্দনভাবে করতে নিয়মিত চিয়া
সিড খেতে হবে। নিয়মিত চিয়া সিড খেলে কখনও শরীরে শক্তির অভাব হয় না। ফলে বিন্দুমাত্র
অলাসতা ছাড়া সমস্ত কাজকর্ম ভালভাবে সম্পাদন করা যায়।
ওজন কমায়
বর্তমানে লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভাসের
কারণে বেশিরভাগ মানুষ মোটা এবং তাদের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এই মোটা মানুষগুলো
তাদের ওজন কমানোর জন্য কত কি খায়! অথচ তারা জানে না ওজন কমাতে চিয়া সিড এর জুড়ি নেই।
নিয়মিত চিয়া সিড খেলে শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে যেয়ে ওজনতো কমবেই সাথে সাথে শরীরে কোন মারাত্মক
রোগ বাসা বাধতে পারবে না। তাই ওজন কমাতে নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
বর্তমানে মানুষ খাদ্যাভ্যাস
ও অলস জীবনযাপনের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক সহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগে ভুগছে। হার্ট
অ্যাটাকের কারণে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ অকালে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অথচ
যদি এইসব মানুষগুলো সচেতন হত এবং সচেতনার সাথে খাদ্য গ্রহণ করতো তাহলে হয়তোবা
তাদেরকে অকালে মারা যেতে হতো না। এই হার্ট অ্যাটাক থেকে মানুষকে রক্ষা করার একটি ঔষধি
খাদ্য হলো চিয়া সিড। নিয়মিত চিয়া সিড খেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে
যায়। তাই হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
মানুষের শরীরে বিভিন্নভাবে
রোগজীবাণু প্রবেশ করে বিভিন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু শরীরে যদি রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা বেশি থাকে তাহলে শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করার পরও কোন মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে
পারে না। শরীরের মধ্যে থাকা এন্টিবডি রোগজীবাণু সাথে ফাইট করে তাদেরকে হারিয়ে দেয়।
ফলে মানুষ অনেক মারাত্মক রোগ থেকে বেচে যায়। তাই প্রত্যেকের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়ানো উচিত। আর চিয়া সিড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর একটি অন্যতম সুপার ফুড।
সুতরাং মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে নিয়মিত চিয়া সিড খেতে হবে।
হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা নিরাময় করে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে
বিভিন্ন ধরনের ব্যথার উপদ্রব দেখা যায়। এই বিভিন্ন ধরনের ব্যথার মধ্যে হাঁটু ও জয়েন্টের
ব্যথা অন্যতম। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথায় কাতর। হাঁটু ও
জয়েন্টের ব্যথার মূল কারণ হলো ক্যালসিয়ামের অভাব। হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথার জন্য
ডাক্তারের কাছে গেলে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট লিখে দেয়। আর এই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট
খেতে খেতে মানুষ হয়রান হয়ে যায় কিন্তু হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা নিরাময় হয় না।
এইসব মানুষগুলো জানে না যে চিয়া সিডে কত বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে। যদি কোন মানুষ
ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট না খেয়ে ৬ মাস একটানা চিয়া সিড খায় তাহলে তার হাঁটু
ও জয়েন্টের ব্যথা চিরতরে বিদায় নিবে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
বর্তমানে এমন কোন লোক নেই
যে ক্যান্সার রোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন না। মানুষ ক্যান্সার রোগ নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার
মূল কারণ এর কোন চিকিৎসা নেই। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে Prevention is better
than cure এই প্রবাদটি অনুসরণ করা উচিত। আর ক্যান্সার প্রতিরোধের অন্যতম প্রাকৃতিক
ঔষধি খাদ্য হল চিয়া সিড। চিয়া সিড অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরা যা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে
লড়াই করে শরীর থেকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। বিশেষভাবে চিয়া সিড মলাশয় পরিষ্কার রাখে
এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। সুতরাং মরণ ব্যাধি ক্যান্সার থেকে বাচতে এবং শরীর
থেকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে প্রত্যেকের নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত।
পড়তে পারেনঃ
- জুম্মা ও তাহাজ্জুদ সহ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়
- সুরা মুলক বাংলা উচ্চারণ ও ফজিলত
- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত
চিয়া সিড এর আরো উপকারিতা
- শরীর টক্সিন মুক্ত রাখে।
- ত্বক ও চুল সুন্দর রাখে।
- যেকোন প্রদাহজনিত ব্যথা দূর করে।
- ভাল ঘুম হতে সাহায্য করে।
- হজমে সহায়তা করে।
- এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসর্ডার দূর করে।
- নখ সুন্দর রাখে।
- ব্লাড সুগার লেভেল নরমাল রাখে।
- ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রনে রাখে।
- কোলেস্ট্রল কমায়।
- পশু-পাখির খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
চিয়া সিডের অপকারিতা
পৃথিবীর প্রতিটা খাদ্য আল্লাহতালার
অশেষ নিয়ামত। কিন্তু সব খাদ্য আবার সবার শরীরে সহ্য হয় না। আবার কেউ কোন খাদ্য
অতিরিক্ত খেলে এতেও সমস্যা হয়। চিয়া সিড সুপারফুড হলেও এর কিছু অপকারিতা
আছে। অ্যালার্জি রোগীদের অবশ্যই চিয়া সিড এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে
চিয়া সিড খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, বদহজম ও গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
শুকনো চিয়া সিড খেলে গলায় আটকে যেয়ে দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই না ভিজিয়ে চিয়া
সিড খাওয়া উচিত না। মাত্রাতিরিক্ত চিয়া সিড খেলে রক্তের ঘনত্ব হ্রাস পেতে পারে। বেশি
পরিমাণে চিয়া সিড খেলে দেহে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেতে পারে।
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম
চিয়া সিড বিভিন্নভাবে খাওয়া
যায়। যেমন: চিয়া সিড স্মুথি বানিয়ে খাওয়া যায়, সালাদ এর সাথে মিশিয়ে
খাওয়া যায়, নারিকেলের পানি ও ফলের রসের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায় এবং শুধুমাত্র
পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়। চিয়া সিড খাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় উপায় হলো
পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া। চিয়া সিড পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ার জন্য এক গ্লাস পানিতে এক
চা চামচ চিয়া সিড এক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর রাত্রে ঘুমানোর আগে এবং সকালে
খালি পেটে দুইবার খান।
চিয়া সিড এর দাম কত?
চিয়া সিড এর দাম কেজি প্রতি
৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। উপজেলা পর্যায়ে অনেক বড় মুদিখানা দোকানের চিয়া সিড কিনতে পাওয়া
যায়। এছাড়া ঢাকার লোকাল মার্কেটে অ্যাভেলেবল চিয়া সিড পাওয়া যায়। অনলাইন
শপ থেকে চিয়া সিড সংগ্রহ করা যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে চিয়া সিড একটি পুষ্টিকর সুপারফুড। এটা সঠিকভাবে গ্রহণ করলে শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।তবে অতিরিক্ত গ্রহণ করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। তাই, নিয়ম মেনে এবং পরিমিত পরিমাণে চিয়া সিড খেতে হবে। যাইহোক, বর্তমানে রোগের দুনিয়ায় চিয়া সিড খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষভাবে ডায়াবেটিস ও হাটু ও জয়েন্টে ব্যথার রোগীদের জন্য চিয়া সিড একটি মহাঔষধ। তাই আমার মনে হয় চিয়া সিড এর উপকারিতা, অপকারিতা ও সঠিক খাওয়ার নিয়ম জেনে শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রত্যেকের নিয়মিত চিয়া সিড খাওয়া উচিত।