জানাজার নামাজ
পবিত্র কুরআনে সূরা আল ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, "কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত" অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি সাক্ষ্য দেয় যে প্রত্যেক মানুষকে একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে পরকালে পাড়ি জমাতে হবে। কারো চিরকাল বেঁচে থাকার কোন সুযোগ নেই। তাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীর ভবোলীলা শেষ হবে এবং পরকালের যাত্রা শুরু হবে। কোন মানুষ মৃত্যুর পর তার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করার যে আনুষ্ঠানিক আয়োজন করা হয় এবং ঐ অনুষ্ঠানে মৃত্যু ব্যক্তির জন্য যে দোয়া ও দুরুদ পাঠ করা হয় তাকে জানাজার নামাজ বলে। জানাজার নামাজ পড়া ফরজে কেফায়া। এই জানাজার নামাজের কিছু নিয়ম কানুন আছে। আজ আমি এই আর্টিকেলে জানাজার নামাজের নিয়ম | জানাজার নামাজের নিয়ত | জানাজার নামাজের দোয়া সহ জানাজার নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জানাজার নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আপনি আর্টিকেলটি
সম্পূর্ণ পড়ুন এবং জানাজার নামাজ সম্পর্কে অনেক অজানা বিষয় জানুন। চলুন তাহলে এখন
জানাজার নামাজ সম্পর্কে একে একে সব কিছু জানা যাক।
জানাজার নামাজের নিয়ম
জানাজার নামাজ একজন ইমামের নেতৃত্বে মৃত্যু ব্যক্তিকে
সামনে রেখে দলবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে বিজোড় সংখ্যক কাতারে চার তাকবীরের সহিত আদায় করতে
হয়। জানাজার নামাজ পড়ার নিয়ম কানুন নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। নিয়ত
করা এবং প্রথম তাকবীরের পর বুকে হাত বেঁধে ছানা পড়া।
২। দ্বিতীয়
তাকবীরের পরে
দরুদে ইব্রাহিম পাঠ করা।
৩। তৃতীয়
তাকবীরের পর মৃত্যু ব্যক্তির জন্য দোয়া পাঠ করা।
৪। চতুর্থ তাকবীরের পর সালাম ফিরিয়ে হাত নামিয়ে জানাজা নামাজ শেষ করা।
জানাজার নামাজের নিয়ত
আরবি
نَوَيْتُ اَنْ اُؤَدِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى اَرْبَعَ تَكْبِيْرَاتِ صَلَوةِ الْجَنَا زَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَا ءُ لِلَّهِ تَعَا لَى وَالصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَالدُّعَا ءُلِهَذَا الْمَيِّتِ اِقْتِدَتُ بِهَذَا الاِْمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ
জানাজার নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ
নাওয়াইতুয়ান উয়াদ্দিয়া লিল্লাহি তা'আলা আরবা আ তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তা'আলা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়ে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়েতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আল্লাহু আকবার।
উল্লেখ্য যে মৃত্যু ব্যক্তির পুরুষ হলে নিয়ত করার সময়
লেহাযাল মাইয়েতে পড়বেন আর মহিলা হলে লেহাযিহিল মাইয়েতে পড়বেন। আপনি যদি আরবীতে
জানাজার নামাজের নিয়ত করতে না পারেন তাহলে বাংলায় করবেন।
জানাজার নামাজের নিয়ত বাংলা
আমি চার তাকবীরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ কিবলামুখী হয়ে মরহুম ব্যক্তির দোয়ার
উদ্দেশ্যে এই ইমামের পিছনে পড়িতেছি আল্লাহু আকবার। তারপরে প্রথম তাকবীর দিয়ে
ছানা পড়বেন এবং দ্বিতীয় তাকবীর দিয়ে দুরুদে ইব্রাহীম পড়বেন। এখন ছানা ও দুরুদে
ইব্রাহিম দেখে নিন।
ছানা
বাংলা উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা
ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
দুরুদে ইব্রাহীম
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদি ওয়া
আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা
হামীদুম মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা
বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
পড়তে পারেনঃ
জানাজার নামাজের দোয়া
জানাযা নামাজের মুনাজাত করা যায় না কিন্তু তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত্যু ব্যক্তির জন্য দোয়া পড়তে হয়। এখন দেখে নিন জানাজার নামাজে তৃতীয় তাকবীর এর পরে কোন দোয়া পড়তে হয়।
জানাজার নামাজের দোয়া বাংলা উচ্চারণ
"আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়েনা ওয়া মাইয়িতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ওয়া ছাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া জাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামী ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমিন।"
মৃত্যু ব্যক্তি যদি নাবালক পুরুষ হয় তাহলে সেক্ষেত্রে জানাজার নামাজে নিম্নের দোয়া পড়তে হবে।
"আল্লাহুমমাজ আল হুলানা ফারতাও ওয়াজ আল হুলানা আজরাও ওয়া জুখরাও ওয়াজ আল হুলানা সাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফায়ান।"
আর মৃত্যু ব্যক্তির যদি নাবালিকা মহিলা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে জানাজার নামাজের নিন্মের দোয়া পড়তে হবে ।
"আল্লাহুম্মাজ আলহা লানা ফারতাও ওয়াজ আলহা লানা আজরাও ওয়া যুখৱাও ওয়াজ আলহা লানা সাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফায়ান।"
জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম
কোন মানুষ মারা গেলে হাজার হাজার মানুষ ঐ মৃত্যু ব্যক্তিকে দেখতে এবং তার জানাজার নামাজে শরীক হতে আসে। আর একজন ব্যক্তি আছে ঐ মৃত্যু ব্যক্তির দাফন কাপন সম্পন্ন করতে এবং জানাজার নামাজ পড়াতে। যিনি জানাজা নামাজ পড়াতে আসেন তিনি হলেন ইমাম। আর একজন ইমাম কিভাবে জানাজার নামাজ পড়বেন তা এখন দেখে নিন।
১। ইমাম
সাহেব কালবিলম্ব না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত্যু ব্যক্তির দাফন কাপন সম্পন্ন
করে জানাজা নামাজ পড়িয়ে তাকে কবর দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
২। মৃত্যু
ব্যক্তিকে সামনে রেখে মৃত্যু ব্যক্তির বুক বরাবর ইমাম সাহেব জানাজার নামাজে
দাঁড়িয়ে যাবেন এবং মুসল্লিদের তার পিছনের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলবেন।
৩। ইমাম
সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে মৃত্যু সম্পর্কে অল্প সময়ের মধ্যে কিছু কথা বলবেন।
উদ্দেশ্য হল সবাইকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
৪। বক্তৃতা
শেষে ইমাম সাহেব মুসল্লিদের জানাজার নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া বলে
দিবেন। এই জানাজার নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া তিনি
আরবি ও বাংলা উভয় ভাষায় বলে দেবেন। আরবিতে না পারলে বাংলায় পড়ার নির্দেশ দিবেন।
৫। মৃত্যু
ব্যক্তি পুরুষ হলে কি দোয়া পড়বেন, মহিলা হলে কি দোয়া পড়বেন, নাবালক পুরুষের ক্ষেত্রে কি দোয়া পড়বেন এবং নাবালিকা মহিলার ক্ষেত্রে
কি দোয়া পড়বেন সবকিছু ইমাম সাহেব মুসল্লিদের বলে
দিবেন।
৬। সবাইকে
চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে ইমাম সাহেব কিবলামুখী হয়ে নিয়ত পড়ে জানাজার নামাজ শুরু
করবেন এবং আল্লাহু আকবার বলে প্রথম তাকবীর দিয়ে বুকে হাত বেঁধে ছানা পড়া শেষ
করবেন।
৭। ছানা
পড়া শেষে দ্বিতীয় তাকবীর দিয়ে দুরুদে ইব্রাহীম পড়বেন কিন্তু বুকে হাত বাধা
থাকবে।
৮। দুরুদে
ইব্রাহীম পড়ার পর তৃতীয় তাকবীর দিয়ে পুরুষ ও মহিলা কিংবা নাবালক ও নাবালিকা
অনুযায়ী জানাযা নামাজের দোয়া পড়বেন।
৯। জানাযা
নামাজের দোয়া পড়ার পর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সালাম ফিরিয়ে জানাযা নামায শেষ
করবেন।
১০। জানাজার নামাজ শেষে মৃত্যু ব্যক্তিকে যত শীঘ্রই সম্ভব কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিবেন।
জানাজার নামাজের ফজিলত
রাসূল সা: এর মুখনিঃসৃত বাণী অনুযায়ী জানাজা নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরেই অন্যতম ফরজ নামাজ হলো জানাজার নামাজ। এজন্য জানাজার নামাজকে ফরজে কিফায়া বলা হয়। প্রত্যেক মানুষের জন্য পৃথিবীতে শেষ নামাজ হলো তার জানাজার নামাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই জানাজার নামাজ মৃত্যু ব্যক্তি করতে পারে না। তাই সবাইকে জানাজার নামাজে অংশগ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করলে বরকত হয়। তাই রাসুল সা: জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করে মৃত্যু ব্যক্তির জন্য আন্তরিকতার সাথে দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।
জানাজার নামাজের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সা: বলেছেন,"যখন তোমরা মৃতের উপর নামাজ আদায় করবে তখন তার জন্য আন্তরিকতার সহিত দোয়া করবে।"
জানাজার নামাজ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন,"কেউ যদি কারো জানাজায় অংশগ্রহণ করে এবং জানাজার নামাজ আদায় করে তবে সেই এক কিরাত সওয়াব অর্জন করবে। তাহলে সে দুই কিরাত সওয়াব অর্জন করবে। এক কিরাত ওহুদ পাহাড়ের চেয়ে বড়।"
অন্য এক হাদীসে জানাজার নামাজ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে আজ কে রোজা ছিলে? আবু বকর রা: বললেন,"আমি।" রাসূল সা: প্রশ্ন করেন,"তোমাদের মধ্যে কে আজ কোন জানাজায় শরিক হয়েছ? হযরত আবু বকর রা: বলেন, "আমি।" তিনি প্রশ্ন করেন,"তোমাদের মধ্যে কে আজ দরিদ্র কে খাদ্য দিয়েছো? হযরত আবু বকর রা: বলেন," আমি।" তিনি আবারও প্রশ্ন করেন," তোমাদের মধ্যে কে আজ কোন অসুস্থ মানুষকে দেখতে গিয়েছ? হযরত আবু বকর রাঃ ইসলাম বলেন, "আমি।" তখন রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম বলেন,"এই কাজগুলো যদি কোনো মানুষের মধ্যে একত্রিত করা হয় তবে সে ব্যক্তি অবশ্যই জান্নাতে যাবে।"
উপরের হাদীসগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে প্রত্যেক
মানুষের জীবনে জানাজার নামাজের অনেক ফজিলত আছে। তাই আশেপাশের কেউ মারা গেলে
প্রত্যেকের অবশ্যই তার জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করে তার জন্য মনে প্রানে আল্লাহ
রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করা উচিত। আমার লেখা আজকের আর্টিকেলটি জানাজার
নামাজের নিয়ম |
জানাজার নামাজের নিয়ত | জানাজার নামাজের দোয়া পড়লে জীবনে কেউ কোনদিন কোন জানাজার নামাজ মিস করবে না। আল্লাহ
রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রত্যেককে মৃত্যু ব্যক্তির জানাজায় অংশগ্রহণ করার তৌফিক
দান করুন, আমিন।
রিলেটেড পোস্টসঃ
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক অজানাকে জানতে নিয়মিত আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শন করুন। আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।