তাহাজ্জুদ নামাজTahajjud Namaz
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো এক ধরনের নফল নামাজ। ফরজ নামাজের পরে অন্যান্য সুন্নত ও নফল নামাজের তুলনায় তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ পড়ার হুকুম দেওয়ার পূর্বে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার হুকুম দিয়েছিলেন। সুতরাং তাহাজ্জুদ নামাজ খুব ফজিলতপূর্ণ একটি নামাজ। যদি কেউ হাশরের ময়দানে সহজ হিসাব নিকাশ চায় কিংবা বিনা হিসাবে বেহেশতে যেতে চায় তাহলে তার ফরজ নামাজের পাশাপাশি নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উচিত। আজ আমি এই আর্টিকেলে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত সহ তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়মTahajjud namaz porar niom
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মত তাহাজ্জুদ নামাজও একই রকম। এর জন্য আলাদা কোন নিয়ম নেই। তবে পার্থক্য হলো এটাই যে এশার নামাজ বাদে সব নামাজ দিনের বেলায় পড়তে হয়। কিন্তু তাহাজ্জুদ নামাজ গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। ফলে অন্যান্য নামাজের তুলনায় তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া খুব কঠিন। তার পরেও যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে প্রকৃত ভালোবাসেন তারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় গভীর রাতে উঠে আরামের ঘুম হারাম করে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে। সুতরাং তাহাজ্জুদ নামাজের প্রতিদান নিশ্চিত বেহেশত যদি তার ফরজ নামাজের ঘাটতি না থাকে।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কোন প্রার্থনা করলে সাথে সাথে তিনি তা কবুল করে নেন যদি প্রার্থনাকারী সুদখোর, ঘুষখোর, জেনাকারী ও পিতা মাতার মনে ব্যাথা দানকারী না হয়। প্রতিদিন রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়ার আসমানে এসে বলতে থাকেন-"কোনো প্রার্থনাকারী আছ কি? যার প্রার্থনা আমি কবুল করব। প্রয়োজন প্রার্থনার কোনো লোক আছ কি? যার প্রয়োজন আমি পূর্ণ করে দেব। এবং কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? যাকে আমি ক্ষমা করে দেব।" (আল হাদীস)
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে আরো অনেক স্পষ্ট দলিল আছে যা এই অল্প সময়ের ভিতর আলোচনা করে শেষ করা একেবারেই অসম্ভব। তাই শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্য তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুযায়ী গভীর রজনীতে উঠে নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব-কর্তব্য ও উচিত।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল
অনেক মানুষ জানে না তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ নাকি সুন্নত নাকি ওয়াজিব নাকি নফল। আসলে তাদের নামাজ উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং ফজিলতপূর্ণ এক ধরনের নফল নামাজ। তবে অন্যান্য নফল নামাজের তুলনায় এই তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মানব জাতির উপরে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের হুকুম জারি হওয়ার আগে আল্লাহ তাআলা তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে এখন সকলের বুঝা উচিত তাহাজ্জুদ নামাজ নফল হওয়ার সত্বেও কত গুরুত্বপূর্ণ একটি নামাজ।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়Tahajjud namaz time
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির উপর দৈনিক যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন প্রত্যেক ওয়াক্তে নামাজের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ইচ্ছা অনুযায়ী যখন খুশি তখন নামাজ পড়া যায় না। এককথায়, নামাজের অনেক বিধিনিষেধ ও সময় আছে। আর তাই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নামাজ পড়তে হয় এবং নিষিদ্ধ সময় যেকোনো প্রকার নামাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। ঠিক একইভাবে তাহাজ্জুদ নামাজের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। এশার নামাজের শেষে তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং সুবেহ সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়।
তবে তাহাজ্জুদ নামাজের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হল রাতের শেষ ভাগ। বলা যায় রাত তিনটাৱ পর থেকে তাহাজ্জুদ নামাজের উপযুক্ত সময়। এই সময় আল্লাহ রব্বুল আলামিন সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য এগিয়ে আসেন এবং বলেন "হে চাদর আবৃত, রাতের সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া।" (সুরা মুজাম্মিল : আয়াত ১-২)
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাতTahajjud namaz rakat
অনেকে হয়তো বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য মন স্থির করেছেন কিন্তু তারা জানেন না তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত। আসলে তাহাজ্জুদ নামাজ দুই রাকাত থেকে শুরু করে ১২ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। মোটকথা তাহাজ্জুদ নামাজ ১২ রাকাত পড়া উচিত। যদি কেউ ১২ রাকাত নামাজ না পড়তে পারেন তাহলে ৮ রাকাত পড়বেন। যদি কেউ ৮ রাকাত পড়তে ব্যর্থ হয় তাহলে ৪ রাকাত পড়বেন। যদি কেউ ৪ রাকাতও পড়তে না পারে তাহলে কমপক্ষে ২ রাকাত পড়বেন। যদি কারো এমন মনে হয় যে রাত্রে উঠতে পারবেন না কিংবা যদি রাত্রে না জাগেন তাহলে তিনি এশার নামাজে বেতের নামাজের পূর্বে ২ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে নিবেন। আবার রাতে যদি জাগতে পারেন তাহলে রাত ৩ টার পরে আবার তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে নিবেন।
পড়তে পারেনঃ
- জানাজার নামাজের নিয়ম ও দোয়া
- মোনাজাতও ইস্তেগফার সহ আত্তাহিয়াতু দুরুদ শরীফ ও দোয়া মাসুরা
- ফজরের নামাজের সময়
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়তTahajjud namaz niyat
যেকোনো নামাজের নিয়ত আরবিতে করতে হয় কিন্তু যদি কারো আরবি নিয়ত জানা না থাকে তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের যেকোনো নামাজের নিয়ত বাংলায় করার সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং যারা আরবি নিয়ত জানেন তারা আরবিতে নিয়ত করবেন। আর যারা আরবি নিয়ত জানেন না তারা বাংলায় নিয়ত করবেন। এখন দেখে নিন তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি ও বাংলা নিয়ত।
তাহাজ্জুত নামাজের নিয়ত
نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ رَكَعَتِى التَّهَجُّدِ - اَللهُ اَكْبَر
বাংলা অর্থ: দু-রাকাত তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করছি……মনে মনে এই উচ্চারণ করে আল্লাহু আকবার বলে বুকে হাত বেধে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া শুরু করতে হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ
অনেকে তাহাজ্জুদ নামাজের পূর্ণাঙ্গ আরবি নিয়ত এবং এর বাংলা উচ্চারণ জানতে চান। প্রকৃতপক্ষে, সকলের তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত জানা উচিত। তাই সকলের সুবিধার্থে তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত এবং তার বাংলা উচ্চারণ নিচে তুলে ধরা হলো।
তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত ও বাংলা উচ্চারন: নাওয়াইতুয়ান উছোয়াল্লিয়া লিল্লাহি তা'আলা রাক'আতাই সালাতিত তাহাজ্জুদী সুন্নাতু রাসূলুল্লাহি তা'আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।"
আপনি আরবিতে না পারলে এভাবেও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে পারেন—--
"আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কিবলামুখী হইয়া তাহাজ্জুতের দু'রাকাত সুন্নত নামাজ পড়িতেছি আল্লাহু আকবার।"
তাহাজ্জুদ নামাজে কোন সূরা পড়তে হয়
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য বিশেষ কোনো সুরাহা নেই। সাধারণ দুই রাকাত নামাজ যেভাবে পড়তে হয় তাহাজ্জুদ নামাজও সেইভাবে দুই রাকাত পড়তে হয়। তবে প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পরে ৩ বার সূরা ইখলাস পড়া উত্তম। দ্বিতীয় রাকাতও ঠিক একই ভাবে পড়তে হয়। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে পড়া নামাজ আল্লাহতালার খুব পছন্দ। তাই সুরা ফাতিহার পরে লম্বা কেরাত পড়তে পারেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু সালাম তাহাজ্জুদ নামাজে সুরা ফাতিহার পরে লম্বা কেরাত পড়তেন।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম
- জায়নামাজের দোয়া পড়ুন।
- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করুন।
- তাকবীরে তাহরীমা আল্লাহু আকবার বলে হাত বাঁধুন।
- ছানা পড়ুন।
- আউযুবিল্লাহসহ বিসমিল্লাহ পড়ুন।
- সূরা ফাতিহা পড়ুন।
- একটি বড় সূরা পড়ুন অথবা সূরা ইখলাস তিনবার পড়ুন অথবা যে কোন একটি সূরা পড়ুন।
- রুকু ও সেজদা আদায় করুন।
- একইভাবে দ্বিতীয় রাকাত পড়ুন।
- তাশাহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পড়ুন।
- সালাম ফিরিয়ে আল্লাহর কাছে যা খুশি তাই চান। ইনশাল্লাহ পাবেন।
এই দুই রাকাতের মত ৪ থেকে ১২ রাকাত পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারেন। তবে যে কয় রাকাত পড়বেন প্রত্যেকদিন একরকম পড়ার চেষ্টা করবেন। পারলে বেশি পড়বেন কম নয়। কমপক্ষে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়বেন কারণ ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত লিখে শেষ করা যাবে না। আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সন্তুষ্টির জন্য, হাশরের ময়দানে হিসাব নিকাশ সহজ করার জন্য এবং পরকালে বেহেশত পাওয়ার জন্য সকল মুসলমানের তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উচিত। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম ইরশাদ করেন "যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামায পড়ায় এমনকি সে যদি জেগে না উঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন।
অনুরুপ কোন মহিলা যদি রাত্রিকালে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাযের জন্য জাগায় এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে।" (আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম আরো বলেন, "ফরজ নামাজের পর সব নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ তথা রাতের নামাজ।" (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
পরিশেষে বলা যায় যে কিয়ামতের কঠিন দিনে যদি কোন ব্যক্তি সহজে আল্লাহর নিকট হিসাব-নিকাশ এবং বেহেশত কামনা করে তাহলে তার নিয়মিত যত্নের সাথে ভক্তি সহকারে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উচিত। এই প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠতম মুফাসিসরে কোরআন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (র.) বলেন, "যে ব্যক্তি হাশরের ময়দানে সহজ হিসাব কামনা করে, তার উচিত হবে আল্লাহ যেন তাকে রাত্রির অন্ধকারে সেজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় পান। তার মধ্যে পরকালের চিন্তা ও রহমতের প্রত্যাশাও থাকা দরকার। (তাফসিরে কুরতুবি, মা’আরেফুল কোরআন, ক্বিয়ামুল লাইল)। তাই আসুন আমরা সবাই দুনিয়ার মোহ ভুলে যেয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত জেনে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া শুরু করে দেই।
রিলেটেড পোস্টসঃ
- সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ সহ ফজিলত
- নামাজের জন্য ১০ টি সূরা ও আয়াত বাংলা উচ্চারণ
- আয়াতুল কুরসি বাংলা উচ্চারণ
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক অজানাকে জানতে নিয়মিত আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শন করুন। আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তাহাজ্জত নামাজে সুন্নত হবে না নফল হবে
উত্তরমুছুন