রোজা গোটা মুসলমান জাতির জন্য একটি আশীর্বাদ।
রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি ও পাপ কাজ থেকে দূরে
থাকা। রোজার উপর ভিত্তি করে গোটা রমজান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ মাসের
প্রথম দশদিনকে বলে রহমত, দ্বিতীয় দশদিনকে বলে বরকত আর
তৃতীয় দশজনকে বলে মাগফেরাত। প্রকৃতপক্ষে, রমজান মাসের ৩০
রোজা পালনের মধ্য দিয়ে যেকোন মুসলমান গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই প্রত্যেক
মুসলমান নর-নারীর রমজান মাসের রোজা রাখা উচিত। আজ আমি আমার এই আর্টিকেলে রোজার
নিয়ত ও ইফতারের দোয়া সহ রোজা ও ইফতার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আপনি আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং ধারাবাহিকভাবে রোজা ও ইফতার সম্পর্কে
জানতে থাকুন।
রোজা
রোজা একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ আত্মনিয়ন্ত্রণ বা আত্মসংযম বা উপবাস বা বিরত থাকা। মানব জাতির আদি পিতা ও প্রথম নবী হযরত আদম আ: জান্নাতের মধ্যে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার তওবা কবুল করেনি। ৩০ দিন পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত আদম আ: এর তওবা কবুল করেন এবং তার সন্তানদের উপর ৩০ রোজা ফরজ করে দেন।
সেই থেকে যুগে যুগে মানুষ রমজান মাসে রোজা পালন করে আসছে। সুতরাং রোজা শুধুমাত্র শেষ নবীর উম্মতের জন্য নয়। প্রত্যেক নবীর যুগে রোজা ছিল এবং কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত রোজা থাকবে, ইনশাল্লাহ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।" (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)
রোজা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে খুবই প্রিয়। রোজাদার ব্যক্তিদের সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই সাক্ষাৎ করবেন এবং নিজের হাতে রোজার পুরস্কার দিবেন। মুসলমানরা যে আল্লাহকে ভয় পায় একমাত্র রোজাই তার বড় প্রমাণ। সব খাদ্য সামনে আছে কিন্তু আল্লাহর অনুমতি নেই এই ভয়ে তারা কিছুই খায় না। আর এটাই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। আল্লাহ এ জন্য রোজাদারদের উপর প্রচন্ড খুশি।
রোজা মুসলমানদের জন্য ঢাল স্বরূপ। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হল রোজা রাখা। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, "আমাদের মহান রব এরশাদ করেছেন, রোজা হল ঢাল স্বরূপ। বান্দা রোজার দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দিবো।"
অন্য এক হাদীসে রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখে, আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্ব নিয়ে যান।"
অতএব মুসলমানদের জন্য রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনে গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র পথ হল রমজান মাসের ৩০ রোজা। এখন চলুন রোজার নিয়ত জেনে নেওয়া যাক।
রোজার নিয়ত
রোজার জন্য নিয়ত করা ফরজ কিন্তু এই নিয়ত আরবিতে বা বাংলায় মুখে উচ্চারণ করা ফরজ নয়। তবে মনে মনে রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ করতে হবে। রোজা রাখার জন্য মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করলেই রোজার ফরজ নিয়ত করা হয়ে যাবে। তারপরেও রোজার নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা সুন্নত। তাই কেউ রোজার নিয়ত মনে মনে না বলে মুখে উচ্চারণ করবেন। তাহলে একসাথে ফরজ ও সুন্নত দুটাই আদায় হয়ে যাবে।
রোজার নিয়ত আরবি
نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم
রোজার নিয়ত বাংলা উচ্চারণ
নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রমাজানাল মুবারাকি ফারদ্বাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাববাল মিন্নি ইন্নিকা আন্তাস সামিউল আলিম।
রোজার নিয়ত বাংলা অর্থ
হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম। তুমি আমার রোজাকে কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী।
রোজার ভঙ্গের কারণ
হযরত আদম আলাই সালাম এর সময় থেকে গোটা মুসলমান
জাতির জন্য ৩০ রোজা ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু এই ফরজ রোজা কয়েকটি ভুলের কারণে ভেঙে
যায়। তাই রোজা রাখার পূর্বে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির রোজা ভঙ্গের কারণ জানা
উচিত। রোজা ভঙ্গের অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ ৬ টি। সেগুলো হলো-
১। রোজা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা।
২। স্বেচ্ছায় পানাহার করা।
৩। হস্তমৈথুন করা।
৪। শিঙ্গা লাগানো কিংবা শরীর থেকে রক্ত বের করা।
৫। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা।
৬। রোজা অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ ও নিফাস হওয়া।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা বাকারার মধ্যে রোজা ভঙ্গের স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা তালাশ কর। আর পানাহার করো যতক্ষণ না পর্যন্ত কালো সুতা থেকে ভোরের শুভ্র সুতা পরিষ্কার ফুটে ওঠে।"
কোরআনের এ আয়াত থেকে রোজা ভঙ্গের প্রধান ৬ টি কারণের
দুটি আমরা জানতে পারি। আর বাকি $ টি কারণ রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম হাদীসে উল্লেখ করেছেন।
তাই মহামূল্যবান রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল করাতে এই ৬ টি রোজা ভঙ্গের কারণ
সম্পর্কে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির সচেতন থাকা উচিত।
পড়তে পারেনঃ
রোজার ফজিলত
রোজার ফজিলত লিখে শেষ করা যাবে না। রোজা মূলত আল্লাহ খুশির জন্য এবং আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দিবেন। রোজাদার ব্যক্তির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছে। এ মর্মে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "রোজা আমারই জন্য। আমি নিজে এর প্রতিদান দিব। আমার বান্দা আমার জন্য পাহাড় ছেড়ে দেয়, কামনা বাসনা ছেড়ে দেয়। রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি খুশি ইফতারের সময়। আরেকটি খুশি আমার সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধের চেয়ে উত্তম।" (বোখারী শরিফ)
রোজার ফজিলত বর্ণনা করতে যেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম আরো বলেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তাহার ও জাহান্নামের মাঝে একটি পরিখা তৈরি করে দেন যা আকাশ ও জমিনের দূরত্বের মত।" (তিরমিজি শরীফ)
রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস, গুনাহ মাফের মাস এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। তাই এ মাসে বেশি বেশি দোয়া-ইস্তিগফার ও ইবাদত করা উচিত। অন্যান্য মাসের দোয়া কবুল না হলেও রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা রোজাদারের দোয়া কবুল না করে পারেন না। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম বলেন, "অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রত্যেক দিন রাতে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।" (মুসনাদে আহমদ )
অন্য এক হাদীসে এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, "যে ব্যক্তি সওয়াব লাভের আশায় ঈমানের সঙ্গে রমজানের রোজা রাখে এবং তারাবির নামাজ পড়ে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।" (বুখারী শরীফ) অতএব রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত জেনে প্রত্যেক মুসলমানের রমজান মাসে ৩০ রোজা রাখা উচিত।
ইফতার
ইফতার অর্থ নাস্তা করা। রোজার শেষে সূর্য ডোবার পর মাগরিবের নামাজের পূর্বে নাস্তা করাকে আরবিতে বা ইসলামের পরিভাষায় ইফতার বলে। ইফতার করা সুন্নত। তবে ইফতার বাধ্যতামূলক নয়। যদি কেউ কোন কারণবশত ইফতার করতে না পারে তাহলে এতে তার রোজার কোন ক্ষতি হবে না। তবে সময়মতো ইফতার করার চেষ্টা করতে হবে। আর খেজুর দিয়ে ইফতার করা উত্তম। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। ইফতারের ক্ষেত্রে একটি জিনিস মনে রাখবেন- যদি ইফতার করার কোনো কিছু না থাকে তাহলে শুধুমাত্র পানি দিয়ে ইফতার করা যায়। আর ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। তাই ইফতার করার সময় প্রত্যেকে মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে ইফতারের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে "ইয়া ওয়াসিয়াল মাগফিরাতি, ইগফিরলী।" এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়বেন যার অর্থ হে মহান ক্ষমা দানকারী! আমাকে ক্ষমা করুন।
ইফতারের দোয়া
রোজার শেষে ইফতার করা এবং ইফতারের দোয়া পড়া সুন্নত। কিন্তু এই দোয়া আরবিতে বা বাংলায় মুখে উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক নয়। তারপরেও ইফতারের দোয়া মুখে উচ্চারণ করা উত্তম। তাই কেউ ইফতার করার সময় বিসমিল্লাহ বলে ইফতার করবেন এবং ইফতার শেষে ইফতারের দোয়া মনে মনে না বলে মুখে উচ্চারণ করবেন।
ইফতারের দোয়া আরবি
اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَ عَلَى رِزْقِكَ وَ اَفْطَرْتُ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِيْمِيْن
ইফতারের দোয়া বাংলা উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা ছুমতু লাকা ওয়া তাওয়াক্কালতু আলা রিজকিকা ওয়া আফতারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।
ইফতারের দোয়া বাংলা অর্থ
হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি আর তোমারই দেওয়া রিজিকের মাধ্যমে ইফতার করলাম।
ইফতার করানোর ফজিলত
কোন রোজাদার ব্যক্তিকে যদি কেউ ইফতার করায় তাহলে ঐ রোজাদার ব্যক্তি যে পরিমাণ সওয়াব পাবেন তিনিও ঠিক সেই পরিমান সওয়াব পাবেন। সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে আরো একটি অতিরিক্ত রোজার সওয়াব দান করবেন। সুতরাং রোজাদার ব্যক্তিকে কোন কিছু দিয়ে ইফতার করানোর চেষ্টা করবেন। ইফতার করানোর সওয়াব অনেক বেশি।
পরিশেষে বলা যায় যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট না করে কোন মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার একমাত্র উপায় হলো রমজান মাসের ৩০ রোজা রাখা। তাই কেউ জান্নাতে যেতে চাইলে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সহ রমজান মাসে ৩০ রোজা রাখুন এবং তার বিধিনিষেধ মেনে চলুন। আর মনে রাখবেন- নিয়ত গুনে বরকত। তাই রোজা রাখার পূর্বে রোজার নিয়ত করুন এবং রোজার শেষে ইফতারের দোয়া পড়ে ইফতার করুন।
রিলেটেড পোস্টসঃ
একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ক অজানাকে জানতে নিয়মিত আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শন করুন। আমার ব্লগ সাইটটি পরিদর্শনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।